মা-বাবা—এই দুটি শব্দেই জড়িয়ে আছে ভালোবাসা, স্নেহ আর আত্মত্যাগের অসীম মহিমা। ইসলাম মা-বাবার প্রতি সন্তানের দায়িত্বকে এতটাই গুরুত্ব দিয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালা তার ইবাদতের সঙ্গে মা-বাবার প্রতি সদ্ব্যবহারকে একত্রে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু বাস্তব জীবনে সব মা-বাবাই কি ন্যায়ের পথ অনুসরণ করেন?
কখনো কখনো দেখা যায়, মা-বাবা সন্তানের প্রতি অবিচার করছেন—বিচারহীনতা, গালাগালি, পক্ষপাত, এমনকি মানসিক বা শারীরিক নিপীড়ন। তখন প্রশ্ন জাগে, একজন মুসলিম সন্তান কী করবে? সে কি প্রতিবাদ করবে? নাকি সব কিছু চুপচাপ মেনে নেবে?
ইসলাম যা বলে
পবিত্র হাদিসে বর্ণিত আছে, ‘মা-বাবার পায়ের নিচে সন্তানের জান্নাত। এর মর্ম হলো, মা-বাবার সঙ্গে সদাচরণ ও তাদের সন্তুষ্ট করার মাধ্যমেই সন্তানরা জান্নাতের উপযুক্ত হবে। এ ক্ষেত্রে বিধান হলো, মা-বাবা সৎকর্মশীল হোক বা পাপী ও হত্যাকারী হোক, এমনকি কাফিরই হোক, তবু তাদের সঙ্গে সদাচরণ করা সন্তানের ওপর অপরিহার্য। যদিও মা-বাবা স্ব স্ব পাপের শাস্তি আল্লাহ তাআলার নিকট ভোগ করবে। কিন্তু সন্তানদের পাপী মা-বাবার সঙ্গেও অসদাচরণ করা বৈধ হবে না।
হ্যা, যদি মা-বাবা শরিয়তবিরোধী কোনো কাজের জন্য সন্তানকে আদেশ দেয়, তাহলে সন্তানরা তাদের ওই হুকুম অমান্য করে তা থেকে বিরত থাকতে হবে। কেননা আল্লাহর হুকুম অমান্য করে অন্য কারো হুকুম মান্য করা যাবে না। তবে সে ক্ষেত্রেও তাদের মা-বাবার সঙ্গে অসদাচরণ করা বৈধ নয়। কোনো মা-বাবা যদি সন্তানের ওপর অত্যাচার করে, তবে তাদের জন্য দোয়া করতে হবে। যখন তাদের মন ভালো থাকে তখন তাদের বোঝানোর চেষ্টা করতে হবে। তবে কোনো অবস্থায়ই খারাপ ব্যবহার করা যাবে না।
ইসলামে মা-বাবার স্থান জান্নাতের কাছাকাছি। রাসুল (সা.) বলেছেন—
‘তোমার মা, তোমার মা, তোমার মা, তারপর তোমার বাবা।’ (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
কিন্তু একই সঙ্গে ইসলাম ন্যায়ের ধর্ম। আল্লাহ তায়ালা বলেন—
‘যদি তারা (মা-বাবা) তোমাকে জোর করে এমন কিছু করতে, যাতে তুমি আমার সঙ্গে শরিক করো, তোমার কোনো জ্ঞান নেই,তাহলে তাদের কথা মানবে না। তবে দুনিয়াবী জীবনে তাদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে।’ (সুরা লুকমান, আয়াত ১৫)
এখানেই ইসলামের সূক্ষ্ম নির্দেশনা, ভুলের বিরোধিতা করা যাবে, তবে সম্মান বজায় রেখেই।
মা-বাবার অন্যায় আচরণের উদাহরণ
- পরিবারের একাধিক সন্তানের মধ্যে পক্ষপাত করা;
- মেয়েদের মতামতকে গুরুত্ব না দেওয়া;
- সন্তানের পছন্দ বা স্বপ্নকে দমন করা;
- অপমানজনক ভাষায় কথা বলা;
- সন্তানকে শারীরিক বা মানসিকভাবে আঘাত করা।
এসব আচরণ স্পষ্টভাবে ইসলামের আদর্শের পরিপন্থি ।
সন্তানের করণীয় কী?
আদব বজায় রেখে কথা বলা: যেকোনো অভিযোগ থাকুক না কেন, কণ্ঠে যেন অপমান না আসে। ‘উফ্’ বলাও নিষিদ্ধ করা হয়েছে কুরআনে। তাই বিনয়ের সুরে, যুক্তিপূর্ণভাবে নিজের কথা বলাই উত্তম।
অন্যায়ের সঙ্গে আপস নয়: মা-বাবা যদি জোর করে গুনাহর পথে চালাতে চান (যেমন- কাউকে ঠকানো, অন্যায় বিয়ে দিতে চাওয়া), তাহলে ইসলামে তা মানা যাবে না। কিন্তু এটাও এমনভাবে করতে হবে যেন সম্পর্কের সেতু না ভেঙে পড়ে।
আত্মীয়স্বজন বা ইসলামিক ব্যক্তিত্বকে সম্পৃক্ত করা: অনেক সময় বাইরের কাউকে মাধ্যমে নিয়ে আসলে মা-বাবার দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসে। বোঝাপড়ার পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
দোয়া ও ধৈর্য : রাসুল (সা.) সব পরিস্থিতিতে আল্লাহর সাহায্য চেয়েছেন। এমনকি যারা তাঁর ওপর অত্যাচার করেছে, তাদের জন্যও দোয়া করেছেন। তাই মা-বাবা যদি ভুলও করেন, তাদের জন্য হেদায়েতের দোয়া করা উচিত।
সীমা অতিক্রম নয়: একটি মুসলিম সন্তানের উচিত, কোনো পরিস্থিতিতেই মা-বাবার সম্মান নষ্ট না করা—তাদের অপমান করে সামাজিকভাবে ‘শিক্ষা দেওয়া’, বা অভিশাপ দেওয়া কখনোই ইসলামের শিক্ষা নয়। আপনি প্রতিবাদ করুন, প্রয়োজন হলে দূরত্ব বজায় রাখুন, কিন্তু ঘৃণা বা প্রতিশোধ নয়।
ইসলাম আমাদের শেখায় ভারসাম্য সম্মান আর প্রতিবাদের, ভালোবাসা আর ন্যায়বোধের। মা-বাবার প্রতি ভালোবাসা যেমন ইবাদত, অন্যায়ের প্রতিবাদ করাও তেমনি দায়িত্ব, তবে তা হতে হবে নরম সুরে, ধৈর্যের সাথে, আল্লাহর ভয় রেখে।
আরটিভি/টিআই