নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার ইদ্রিস আলীর ছেলে রুহুল আমিন। চার ভাইয়ের মধ্যে রুহুল আমিন সবার ছোট। ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে মা মারা যায় অনেক আগে। রুহুল আমিন ছিলেন অনেক মেধাবী একজন ছাত্র। সুমধুর কোরআন তেলওয়াত করতে পারে সে। রূপগঞ্জ ইউনিয়নের আযান প্রতিযোগিতায় হয়েছিলেন দ্বিতীয়। সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় বেশ কয়েকবার সেরা হন তিনি। ২০১০ সালে দাখিল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। এরপরেই তার জীবনে অন্ধকার নেমে আসে। পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের আগেই তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। তারপর থেকে শুরু হয় তার দুর্বিসহ জীবনযাপন।
রুহুল আমিনের বড় ভাই রুপ মিয়া জানান, মানসিক ভারসাম্য হারানোর পর থেকেই সে ঘরে ভাঙচুর করে, চিৎকার চেঁচামেচি করে এবং আশপাশের লোকজনও তার মারধরের শিকার হন। এ সময় প্রতিবেশীরা পরামর্শ দেন, রুহুল আমিনকে তালাবদ্ধ করে রাখতে। আর কোনো উপায় না পেয়ে পরিবারের লোকজন তাকে শিকলবন্দি করতে বাধ্য হয়।
তিনি আরও বলেন, চিকিৎসার অভাবে তার ভাই (রুহুল আমিন) আজকে অচল হয়ে আছে। চিকিৎসা পেলে সে অবশ্যই সুস্থ হয়ে যাবে। রুহুল আমিনকে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়। নেই কোনো তোশক, আছে শুধু পাটির একটি বিছানা খাটের ওপর। জরাজীর্ণ ছোট্ট টিনের ঘরে বসবাস করে সে। আর এভাবেই কেটে যায় তার জীবনের প্রায় ৮ বছর।
রুহুল আমিনের বাবা ইদ্রিস আলী জানান, এলাকার মানুষের সাময়িক সাহয়তায় তার চিকিৎসাও করানো হয়। কিছুদিন ঠিক থাকলেও আগের অবস্থায় ফিরে যায় সে। গরু আর জায়গা-জমি বিক্রি করেও লাভ হয়নি। দারিদ্র্যতা আর আর্থিক অস্বচ্ছলতা যেন বড় বাধা রুহুল আমিনকে সুস্থ জীবনে নিয়ে আসার জন্য। ইদ্রিস আলীর মতে, সঠিক চিকিৎসা আর সরকার যদি তাদের পাশে দাঁড়ান তাহলে তার ছেলেকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তিনি আরও জানান, তার ছেলে প্রতিবন্ধী ভাতা পায়। ৬ মাস পর পর ৪ হাজার ৫০০ টাকা পায় কিন্তু এতে তেমন কিছু করতে পারেন না তারা।
গ্রামবাসী রুহুল আমিনের পরিবারের ব্যাপারে বলেন, তারা অনেক দরিদ্র এবং আর্থিকভাবে তেমন স্বচ্ছল নয়। তাই তাদের পক্ষে রুহুল আমিনকে চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়নি। যে কারণে রুহুল আমিনকে এমন অবস্থায় পার করতে হয় এতটা বছর। প্রতিবেশীরা জানান, প্রথমে তারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন এতে চিকিৎসাও হয় রুহুল আমিনের কিন্তু বেশি দিন সে সুস্থ জীবনযাপন করতে পারেনি এবং পূর্ববস্থায় ফিরে যায় সে। এখন এলাকাবাসীর প্রত্যাশা, যদি সরকারিভাবে কোনো সাহায্য সহযোগিতা আসে এবং সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে রুহুল আমিন ভালো হয়ে যাবে।
রুহুল আমিনের এমন দুর্বিসহ জীবনের কথা শুনে ইন্সপিরেশন ওয়েলফেয়ার সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দা মুনিরা ইসলাম রুহুল আমিনের পাশে দাঁড়ান এবং তাৎক্ষণিক রুহুল আমিনকে শিকলমুক্ত করেন। হাত-পায়ের নখ কেটে রুহুল আমিনকে নিয়ে যান সেলুনে। মুহূর্তেই যেন রুহুল আমিন সতেজ হয়ে ওঠেন। তারপর তাকে নতুন পোশাক উপহার দেন। নতুন পোশাকে রুহুল আমিনকে দেখা যায় বাকি দশজন সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের মতোই। মুহূর্তেই যেন আনন্দের ছায়া ভেসে ওঠে রুহুল আমিনের মুখে।
উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. আইভি ফেরদৌস জানান, যেহেতু বিষয়টা দৃষ্টিগোচর হয়েছে তাই রুহুল আমিনের জন্য সঠিক ব্যবস্থা নেব। তাকে সামান্য কাউন্সেলিং এবং দেখাশোনা করলেই সে সুস্থ জীবনে ফিরে আসবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
সৈয়দা মুনিরা ইসলাম সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. রিয়াজ উদ্দিনের সঙ্গে রুহুল আমিনের বিষয়ে কথা বললে তিনি বলেন, রুহুল আমিনের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা যতটুকু দেওয়া সম্ভব তারা করবেন। এ ছাড়া উপজেলা ও ইউনিয়ন চেয়ারম্যানসহ উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের সঙ্গে আলোচনা করার মাধ্যমে অবগত করা হবে। এ ছাড়াও সমাজসেবা নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানকেও অন্তর্ভুক্ত করবেন তিনি।
ইন্সপিরেশন ওয়েলফেয়ার সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দা মুনিরা ইসলাম বলেন, মানসিকভাবে যারা অসুস্থ তাদেরকে শিকলবন্দি করে রাখা কোনো চিকিৎসা না। বরং এটা তাদেরকে মানসিকভাবে আরও বিপর্যস্ত করে ফেলে। তাদের জন্য দরকার পরিচর্যা, যত্ন ও ভালোবাসা। সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে তাদেরকে স্বাভাবিক জীবনে নিয়ে আসা সম্ভব এবং তারা আর সব সাধারণ মানুষের মতোই সুন্দর জীবন অতিবাহিত করতে পারবে।