নজরুলের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা 

আরটিভি নিউজ

বুধবার, ১৬ নভেম্বর ২০২২ , ০২:০৩ পিএম


নজরুলের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা 

হাত-পা ও কোমরে শিকল বাঁধা। গায়ে জড়ানো একটি কাপড়। ঘরে শোয়ার জন্য রয়েছে একটি বিছানা। একপাশে টিন ও অন্য পাশে  ভাঙা বেড়া, যা  ঢাকা হয়েছে কাপড় দিয়ে। এভাবেই এক অমানবিক জীবনযাপন করছিলেন নজরুল ইসলাম।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার বান্দুরাগ্রামের নজরুল ইসলাম, মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ২০ বছর ধরে শিকলবন্দি ছিলেন। কোরআনে হাফেজ তিনি। আট-দশজন মানুষের মতো স্বাভাবিক জীবন ছিল তার। কিন্তু এই স্বাভাবিক জীবনে বিপর্যয় নেমে আসে, যখন ভালোবাসার মানুষটির বিয়ে হয়ে যায় অন্য কারও সঙ্গে। মনের এই মানুষকে ভুলে থাকার জন্য নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। এক পর্যায়ে, মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। তারপর থেকেই শুরু হয় তার জীবনবন্দির সূচনা। 

বিজ্ঞাপন

পরিবারের সদস্যদের মতে, ঘরে ভাঙচুর ও মানুষকে আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করতে এমন পদক্ষেপ নিতে হয় তাদেরকে। নজরুলের বড় বোন বলেন, মানসিক ভারসাম্য হারানোর পর তাকে দমন করার জন্য পাবনা মানসিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এতে কিছুটা সুস্থ হলেও আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে চিকিৎসা করানো আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

নজরুলের মা ছেলের যাবতীয় খরচ চালাতেন মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ করে। যার ফলে, ছেলের উন্নত চিকিৎসা করানো তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।

নজরুলের প্রতিবেশীরা জানান, তারা কমবেশি সহযোগিতা করেন; কিন্তু চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল হওয়ায় সবার পক্ষে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়ে উঠে না। তারা ইচ্ছা প্রকাশ করেন, সরকার যদি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়; তাহলে অনেক ভালো হত।

বিজ্ঞাপন

অভাব-অনটনের সংসারে যেখানে দুবেলা খাবার জোগাতে নজরুলের মা-বাবাকে হিমশিম খেতে হয়, সেখানে ছেলের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা চালানো বড়ই কষ্টসাধ্য। নজরুলের জীবনে কষ্ট যেন আরও বেড়ে যায় তার মা-বাবার মৃত্যুর পর।

বিজ্ঞাপন

নজরুলের এমন দুর্বিষহ জীবনের কথা শুনে ইন্সপিরেশন ওয়েলফেয়ার সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দা মুনিরা ইসলাম তার বাড়িতে যান। সমাজে পিছিয়ে পড়া ও বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন মানুষদের পাশে দাঁড়ানো ও সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন।  

নজরুলের এমন অবস্থা দেখে, তিনি দ্রুত তাকে শিকলমুক্ত করে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে চিকিৎসার জন্য ভর্তির ব্যবস্থা করেন। ২০ দিনের চিকিৎসা শেষে, নজরুলকে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে যায় সৈয়দা মুনিরা ইসলাম ও তার পরিবার।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক প্রফেসর ড. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দারের মতে, উনাকে (নজরুল)  শিকলে বাঁধা অবস্থায় নিয়ে আসা হয়, চিকিৎসার পরে অবস্থার উন্নতি হয়েছে। এখন আর বাঁধতে হয় না, উনি এখন স্বাভাবিক মানুষদের মতোই। পরিবারের সান্নিধ্যে থাকলে এখন থেকে নজরুল সুস্থ জীবনযাপন করতে পারবে।

নজরুল নতুন জীবন ফিরে পাওয়ায়, তার পরিবারের সদস্যরা অনেক খুশি হন। পরিবারের মতে, হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়ার পর থেকে সে আগের থেকে অনেকটা সুস্থ। 

উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মিজানুর রহমান প্রতিবন্ধী কার্ড করার আশ্বাস দিয়েছেন, একই সঙ্গে চিকিৎসা ও আর্থিক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

সৈয়দা মুনিরা ইসলাম আশা প্রকাশ করেন, সমাজে বিত্তবানদের ও অর্থশালীদের সহযোগিতাই পারে তাদের জীবনকে সুন্দর ও সহজ করতে। 

নজরুল এখন অনেকটা সুস্থ-স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারেন, গবাদিপশুর ঘাস সংগ্রহসহ পারিবারিক নানা কাজে একটু একটু করে সাহায্য করেন। এখন তাকে প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ খাওয়ানো হয়। সে এখন নিয়মিত সরকারি ভাতা পাচ্ছেন। স্থানীয় চিকিৎসকদের সহযোগিতায় পাচ্ছেন স্বাস্থ্যসেবা।

স্থানীয় চিকিৎসকদের মতে, নজরুল ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরে আসছেন। এদিকে এলাকাবাসী এবং নজরুলের পরিবার, সৈয়দা মুনিরা ইসলাম ও আরটিভির এমন উদ্যোগের প্রশংসা করেন।

ভবিষ্যতেও নজরুলের পাশে থাকার আশা প্রকাশ করেছে ইন্সপিরেশন ওয়েলফেয়ার সোসাইটি। চিকিৎসার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার জন্য সার্বিক সহায়তারও আশ্বাস দেওয়া হয়। সমাজে নজরুলের মতো মানুষদের প্রতি সহনশীল হওয়ার আহ্বান জানায় সংস্থাটি।

নজরুল ও তার পরিবারকে দেখতে প্রায়ই ছুটে যান সৈয়দা মুনিরা ইসলাম।নজরুলের শারীরিক অবস্থা ও চিকিৎসার অগ্রগতি নিয়ে পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। প্রাথমিকভাবে, গবাদিপশু লালনপালন করতে নজরুলকে আর্থিক সহায়তা দেন।

শিকলবন্দি জীবনের দুর্বিষহ গল্পকে পিছনে ফেলে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবে এমন প্রত্যাশা সবার। নজরুলের পরিবারকে স্বাবলম্বী করার জন্য সৈয়দা মুনিরা ইসলাম একটি সেলাই মেশিন প্রদান করেন পাশাপাশি নতুন জামাও দেন নজরুলকে।

সৈয়দা মুনিরা ইসলাম জানান, যদি শুরুতেই নজরুল সঠিক চিকিৎসা পেত তবে আজ তাকে শেকলবন্দি হয়ে এমন অমানবিক জীবন কাটাতে হতো না। নজরুল এখন স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াতে পারছে এবং ভালো আছে। নজরুল তার জীবনের এমন পরিবর্তনে অনেক খুশি, সুস্থভাবে জীবনযাপনের জন্য প্রতিবেশী ও সবার সহায়তা চান তিনি।

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিজ্ঞাপন

Loading...


© All Rights Reserved 2016-2025 | RTV Online | It is illegal to use contents, pictures, and videos of this website without authority's permission