শিল্পবিপ্লবের পর থেকে মানবসৃষ্ট কার্বন নিঃসরণ ও নির্বিচারে বন উজাড়ের ফলে প্রকৃতি আজ ভয়াবহ প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠেছে। এই ধারাবাকিতায় জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আমেরিকায় ধেয়ে আসছে ‘ধ্বংসলীলা’।
সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর শীতকালীন ঝড় নরস্টারস ভবিষ্যতে আরও ধ্বংসাত্মক রূপ নিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলে এই ঝড় প্রবল বৃষ্টি, তুষারপাত ও বন্যার মাধ্যমে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির আশঙ্কা সৃষ্টি করছে।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন জানিয়েছে, সাধারণত সেপ্টেম্বর থেকে এপ্রিল মাসের মধ্যে নরস্টার ঝড়গুলো সৃষ্টি হয়। উত্তরের ঠান্ডা আর্টিক বাতাস এবং আটলান্টিক মহাসাগরের উষ্ণ ও আর্দ্র বাতাসের সংঘর্ষে এগুলো ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর জন্য এই ঝড় একটি বড় হুমকি।
সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত কয়েক দশকে কয়েকটি নরস্টার ঝড় এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, সেগুলোর নামকরণও করা হয়েছে দুর্যোগ চলচ্চিত্রের মতো। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৯৩ সালের মার্চে আঘাত হানা ঝড়ে ঘণ্টায় ১০০ মাইল গতির বাতাস এবং ৬০ ইঞ্চি পর্যন্ত তুষারপাত হয়। এতে প্রাণ হারান ২০০ জনেরও বেশি।
এ ছাড়া, ২০১০ সালের আরেকটি ভয়াবহ ঝড়ের নাম দেওয়া হয়েছিল স্নোম্যাগেডন। এই ঝড়ে পেনসিলভেনিয়া, মেরিল্যান্ড, ভার্জিনিয়া ও পশ্চিম ভার্জিনিয়ায় ২০ ইঞ্চিরও বেশি তুষারপাত হয়, প্রাণহানি ঘটে অন্তত ৪১ জনের, আর বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন লাখো মানুষ।
সেই সময় ফিলাডেলফিয়ার একটি হোটেলে তিনদিন আটকে ছিলেন ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার জলবায়ুবিজ্ঞানী মাইকেল মান। সেখান থেকেই তার মনে প্রশ্ন জাগে- বৈশ্বিক উষ্ণতা কি এই ধরনের ঝড়ের আচরণ বদলে দিচ্ছে?
মান বলেন, নর'ইস্টার তীব্রতর হওয়ার কারণ হল ‘মৌলিক পদার্থবিদ্যা’। উষ্ণ সমুদ্র এবং বাতাসের অর্থ হল বায়ুমণ্ডলে আরও বাষ্পীভবন এবং আরও আর্দ্রতা, যা আরও তীব্র বৃষ্টি বা তুষারপাতের আকারে বেরিয়ে আসে। এই ঝড়গুলি যে পরিমাণ ক্ষতি করতে পারে তা আরও ভালভাবে বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে তারা কীভাবে উষ্ণ বিশ্বে পরিবর্তিত হবে।
উদাহরণস্বরূপ, ১৯৬২ সালে ‘অ্যাশ ওয়েডনেসডে’ ঝড় পূর্ব উপকূলে বিশাল ধ্বংসযজ্ঞ চালায়, যার ফলে আজকের অর্থে কয়েক বিলিয়ন ডলারের সমান মোট অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছিল। এটি একটি বড় ভূমিধসকারী হারিকেনের সমান ক্ষতি করেছিল।
সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল, আর্টিক অঞ্চলের উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে নরস্টার ঝড়ের সংখ্যা কমবে। কিন্তু এ ধরনের ঝড়ের তীব্রতা নিয়ে তখন পর্যন্ত নির্ভরযোগ্য কোনো গবেষণা ছিল না।
সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা ৯০০টিরও বেশি নরস্টার ঝড় বিশ্লেষণ করে একটি ডিজিটাল অ্যাটলাস তৈরি করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল একাডেমি অফ সায়েন্সেস-এ প্রকাশিত এই গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৪০ সাল থেকে এসব ঝড়ে বাতাসের গতি গড়ে ৬ শতাংশ বেড়েছে এবং বৃষ্টি ও তুষারপাতের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ।
এই গবেষণার ভিত্তিতে উডওয়েল ক্লাইমেট রিসার্চ সেন্টার-এর জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী জেনিফার ফ্রান্সিস সতর্ক করে বলেন, ‘নরস্টার হলো উত্তর-পূর্ব আমেরিকার এক ভয়াবহ প্রাকৃতিক শক্তি, যা বারবার আঘাত হানে। ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতির তুলনায় আগাম প্রস্তুতি অনেক কম ব্যয়বহুল। এখন থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া দরকার।’
উষ্ণতর বিশ্বে নর'ইস্টারের সংখ্যা কম হবে, এই বিষয়ে একটি সাধারণ ঐক্যমত্য রয়েছে, কারণ আর্কটিক উত্তর গোলার্ধের অন্যান্য অংশের তুলনায় দ্রুত উত্তপ্ত হচ্ছে, যার অর্থ ঝড়ের জ্বালানি হিসেবে তাপমাত্রার বৈপরীত্য কম।
কিন্তু যা স্পষ্ট নয় তা হল এই ঝড়গুলির তীব্রতার কী হবে, যা অপ্রচলিত বলে মনে করা হচ্ছে, মান বলেন।
এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য, বিজ্ঞানীরা ১৯৪০ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে নর'ইস্টার বিশ্লেষণ করার জন্য ঐতিহাসিক তথ্য এবং একটি ঘূর্ণিঝড় ট্র্যাকিং অ্যালগরিদম ব্যবহার করেছেন, এই ঝড়গুলির একটি ডিজিটাল অ্যাটলাস একত্রিত করেছেন।
ন্যাশনাল একাডেমি অফ সায়েন্সেসের কার্যপ্রণালীতে সোমবার প্রকাশিত গবেষণা অনুসারে, তারা মোট ৯০০টি বিশ্লেষণ করেছেন এবং ১৯৪০ সালের পর থেকে সবচেয়ে তীব্র নর'ইস্টারের সর্বোচ্চ বাতাসের গতিবেগ প্রায় ৬% বৃদ্ধি পেয়েছে।
এটি ছোট শোনাতে পারে তবে এটি ঝড়ের ক্ষতিকে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করে। বাতাসের গতিবেগে ৬% বৃদ্ধি ঝড়ের ধ্বংসাত্মক সম্ভাবনার ২০% বৃদ্ধির সমান, মান বলেন, এটি যথেষ্ট। এই ঝড়ের ফলে বৃষ্টিপাত এবং তুষারপাতের হারও প্রায় ১০% বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব শুধু উষ্ণতা বৃদ্ধিতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা মানুষের জীবন, অবকাঠামো ও অর্থনীতির ওপরও সরাসরি আঘাত হানছে, এমনকি উন্নত দেশগুলোতেও। নরস্টার ঝড়গুলো তারই এক ভয়াল প্রমাণ।
আরটিভি/কেএইচ