গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ ১৭ বছরের শাসনের অবসান ঘটার পরপরই হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়ার বিভিন্ন তথ্য সামনে এসেছে। ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই সেসব অর্থ পুনরুদ্ধারে আশ্বাস দিয়ে আসছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। অর্থ পুনরুদ্ধারে চেষ্টা-তদবিরও চলছে; যদিও অগ্রগতি তেমন আশাব্যঞ্জক নয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য অনুসরণীয় উদাহরণ সৃষ্টি করেছে মধ্য এশিয়ার দেশ কাজাখস্তান।
মাত্র দুই বছরের চেষ্টায় ১ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ সম্পদ ফেরত আনতে সক্ষম হয়েছে দেশটি, যার মধ্যে ১ দশমিক ২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার নগদ এবং বাকিটা ভৌত সম্পদ।
কাজাখস্তানের শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যম দ্য আস্তানা টাইমস-এর এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন তথ্য।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, উদ্ধার হওয়া এই বিপুল অর্থ দেশটির রাষ্ট্রীয় তহবিলে স্থানান্তরিত হয়েছে, যা স্কুল, হাসপাতাল, ক্রীড়া এবং মৌলিক অবকাঠামোর মতো সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যবহার করছে কাজাখস্তান সরকার।
দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের পাচার করা অর্থ ফেরত আনার জন্য দুই বছর আগে যুগান্তকারী এক আইনে স্বাক্ষর করেন কাজাখস্তানের রাষ্ট্রপতি কাসিম-জোমার্ট টোকায়েভ। মূলত ২০২২ সালের জানুয়ারিতে কাজাখস্তানের ইতিহাসের বৃহত্তম বিক্ষোভের এক বছরেরও বেশি সময় পরে এই বৃহৎ আকারের সংস্কারের ফলে আইনের জন্ম হয়।
এই আইনের আওতায় ফেরত আসা সম্পদ গ্রহণ, সংরক্ষণ এবং বিক্রির তত্ত্বাবধানে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে রিটার্নড অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি নামে বিশেষ একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করে কাজাখস্তান সরকার। এর এক মাস পর প্রসিকিউটর জেনারেলের অফিসের অধীনে গঠিত হয় সম্পদ পুনরুদ্ধার কমিটি।
আইন অনুসারে, অবৈধ সম্পদ উত্তোলন প্রকল্পে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যদি সম্পদের আইনি উৎস সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেন, তাহলে তারা সেই সম্পদের মালিক ও তার সহযোগীদের একটি বিশেষ সম্পদ পুনরুদ্ধার রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দেবেন। পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন এবং সংসদ সদস্য, জনসাধারণ, মন্ত্রী ও রাষ্ট্রীয় সংস্থার প্রধানদের সমন্বয়ে গঠিত একটি সরকারি কমিশনের মাধ্যমে।
তবে, প্রাথমিকভাবে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদেরকে বিজ্ঞপ্তি বা চিঠির মাধ্যমে তাদের সম্পত্তি বৈধভাবে অর্জিত হয়েছে—তা প্রমাণ করার জন্য এক থেকে তিন মাস পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়। যদি ব্যক্তি তার সম্পদের বৈধতা প্রমাণ করতে না পারেন, তাহলে সম্পদগুলোকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবৈধ বলে চিহ্নিত করা হয়।
সেইসঙ্গে, অবৈধ সম্পদের মালিককে স্বেচ্ছায় সম্পদ ফেরত দেওয়ারও সুযোগ দেয় কাজাখস্তান সরকার এবং সেক্ষেত্রে তাদের নাম ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম গোপন রাখা হয়। এই গোপনীয়তার বিষয়টিকে নতুন আইনে বৈধতা দেওয়া হয়েছে, যেন অবৈধ সম্পদ সরকারের কাছে হস্তান্তরে কেউ ভীত না হন।
এ ব্যাপারে গত ১৫ জুলাই সরকারি বৈঠকের পর এক সংবাদ সম্মেলনে কাজাখস্তানের প্রধানমন্ত্রী ওলজাস বেকতেনভ বলেন, ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সম্পদ স্বেচ্ছায় ফেরত দেওয়ার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মালিকদের সঙ্গে চুক্তিতে পৌঁছেছে সরকারি কমিশন। আইন অনুসারে, কোনো নির্দিষ্ট নাম প্রকাশ করা হবে না। আমি মনে করি, এটা ঠিকই আছে। কারণ এই প্রসঙ্গে বিশিষ্ট ব্যবসায়িক ব্যক্তিত্বদের নাম প্রকাশ্যে আনাটা তাদের নেতৃত্বাধীন বা মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
এই আইনের সুফল ইতোমধ্যেই পেতে শুরু করেছে কাজাখস্তান সরকার। ফেরত আসা সম্পদের তালিকা নিয়মিতভাবে নিজেদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে নিলামের জন্য পোস্ট করছে দেশটির রিটার্নড অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি। আর নিলাম থেকে প্রাপ্ত সমস্ত অর্থ যুক্ত হচ্ছে বিশেষ রাষ্ট্রীয় তহবিলে।
এখানেই শেষ নয়, স্বচ্ছতা বজায় রাখতে কাজাখস্তানের বাজেট কর্তৃপক্ষ প্রতি মাসে ট্রেজারির ডিজিটাল সিস্টেম ব্যবহার করে বিশেষ রাষ্ট্রীয় তহবিলে অর্থের প্রবাহ পর্যবেক্ষণ করে। মন্ত্রণালয়ের মতে, যদি কেন্দ্রীয় বা স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলো নির্মাণ দরপত্রের সময় বা কোনো প্রকল্প সম্পন্ন করার পরে অর্থ সঞ্চয় করে, অথবা চুক্তি স্বাক্ষরে বিলম্বের কারণে ছয় মাসের মধ্যে তহবিল ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তাদের এক মাসের মধ্যে অব্যবহৃত অর্থ তহবিলে ফেরত দিতে হবে।
২০২৫ সালের মে মাসে মন্ত্রণালয় কর্তৃক নির্ধারিত নিয়ম অনুসারে, সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে তহবিল থেকে কত টাকা গৃহীত এবং ব্যয় করা হয়েছে তার বিশদ বিবরণসহ ত্রৈমাসিক ও বার্ষিক প্রতিবেদন জমা দিতে হবে।
এদিকে, যদিও অবৈধভাবে অর্জিত ও পাচার হওয়া অর্থ পুনরুদ্ধার কার্যক্রমে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে কাজাখস্তান সরকার, কিন্তু এই অর্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও স্বচ্ছতা বজায় রাখা জরুরি বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা। সম্পদ পুনরুদ্ধারের মূলে রয়েছে জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশন। জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ অফিসের (ইউএনওডিসি) আঞ্চলিক দুর্নীতিবিরোধী উপদেষ্টা ভ্লাদিমির কোজিন বলেন, দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশনের প্রেক্ষাপটে আমরা যখন সম্পদ পুনরুদ্ধারের কথা বলি, তখন অপরাধীরা সাধারণত সরকারি কর্মকর্তা বা সরকারি পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি, যারা রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি আত্মসাৎ এবং পরবর্তীতে অর্থ পাচারের মতো অপরাধ করেন। পুনরুদ্ধারকৃত সম্পদ রাষ্ট্রীয় বাজেটে ফেরত পাঠানো যেতে পারে, তবে এই তহবিলগুলো কীভাবে ব্যবহার করা হয়, তাতেও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য একটি ইতিবাচক অনুশীলনের প্রয়োজন রয়েছে। কোন কোন জাতীয় উন্নয়ন কর্মসূচিতে এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে এগুলো বিনিয়োগ করা হয়েছে, তা স্পষ্টভাবে দেখানো গুরুত্বপূর্ণ। এই সংস্কারগুলো অপরিহার্য এবং সময়োপযোগী—কেবল কাজাখস্তানের জন্য নয়, অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের জন্যও।
এ বিষয়ে কাজাখস্তানের প্রধানমন্ত্রী বেকতেনভ বলেন, এই প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব নেই। কার্যকর কমিশনের মাধ্যমে আমরা যে তহবিল পুনরুদ্ধার করি, তা সামাজিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য পূরণে বরাদ্দ করা হয়। এর মধ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং জনসাধারণের জন্য উপযোগী অসংখ্য প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আমরা নিয়মিত সব তথ্য শেয়ার করি।
আরটিভি/এসএইচএম/এআর