জুলাই অভ্যুত্থান যেন ব্যর্থ না হয়

আব্দুর রহিম

বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫ , ০১:১৬ পিএম


জুলাই অভ্যুত্থান যেন ব্যর্থ না হয়
ছবি: সংগৃহীত

ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি; স্বাধীনতার মাস মার্চ এবং বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। এই তিনটি মাস বাঙালির জীবনে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বাঙালির আত্মমর্যাদা, সংগ্রাম আর মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার যে শক্তি, তা এই তিনটি মাসেই প্রমাণ হয়েছে। এই তিন মাসের সঙ্গে নতুন করে যোগ হয়েছে জুলাই মাস। শেখ হাসিনার টানা ১৬ বছরের শাসনেরও অবসান ঘটে এই জুলাই মাসে। দিনটি ছিল গত বছরের ৩৬ জুলাই (আগস্টের ৫ তারিখ)। ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে এদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সামরিক বিমানে ভারতে চলে যান। বিজয় উল্লাসে মেতে উঠেন গণতন্ত্রকামী কোটি জনতা। এই আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন এদেশের ছাত্র সমাজ।

বিজ্ঞাপন

গত বছরের ১ জুলাই শিক্ষার্থীদের ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’ ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে’ রূপ নেয়। এটি ছিল প্রায় ১৬ বছরের স্বৈরতান্ত্রিক আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সূচনাবিন্দু। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনই শেষ পর্যন্ত ‘জুলাই বিদ্রোহে’ রূপ নেবে, শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ একত্রিত হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে বৃহত্তর গণআন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়বে এটা ছিল কল্পানাতীত।

ছাত্রদের এই অসন্তোষের সূচনা ঘটে ২০১৮ সালের কোটা বাতিলের সরকারি প্রজ্ঞাপনকে হাইকোর্ট কর্তৃক অবৈধ ঘোষণা করার রায়ের পর। সরকার ২০১৮ সালে তীব্র ছাত্র আন্দোলনের চাপে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করেছিল। কিন্তু হাইকোর্টের রায়ে ৫৬ শতাংশ কোটা পুনঃপ্রবর্তিত হয়; যাতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারীদের জন্য ১০ শতাংশ, পশ্চাৎপদ জেলার জন্য ১০ শতাংশ, সংখ্যালঘুদের জন্য ৫ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়। ছাত্ররা এই ব্যবস্থাকে মেধাবীদের প্রতি বৈষম্য হিসেবে মনে করে প্রতিবাদে রাস্তায় নামে।

বিজ্ঞাপন

সরকার প্রতিবাদকারীদের কঠোরভাবে দমন করতে চাইলে পরিস্থিতি বিদ্রোহে রূপ নেয়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারপন্থী সন্ত্রাসীরা একযোগে আক্রমণ চালালে অন্তত ১ হাজার ৪০০ জন নিহত এবং প্রায় ২০ হাজার  জন আহত হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী ইতিহাসে এটা ছিল সবচেয়ে নিষ্ঠুর দমনপীড়ন। অনেকে বিশ্বাস করেন, এই জুলাই বিদ্রোহের মধ্য দিয়েই ২০০৮ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে। ২০২৪ সালের ১ জুলাই এই আন্দোলন পুরো মাত্রায় শুরু হলেও এর গোড়াপত্তন ঘটে ৫ জুন। ওইদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থীরা হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় রাস্তায় নামে।

আরও পড়ুন

আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক এবং বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া তার ‘জুলাই: মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু’ বইতে লিখেছেন, ‘৫ জুন বিকেলে আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজের পাশে চানখারপুলে স্কুটি মেরামত করাচ্ছিলাম। তখন ফেসবুকে দেখি- হাইকোর্ট কোটা পুনর্বহাল করেছে। মনে হলো ২০১৮ সালের অর্জনগুলো ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে।’ এরপর কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে এক বৈঠকের মাধ্যমে প্রতিবাদ কর্মসূচির সূচনা হয়। রাত সাড়ে ৭টায় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী’ ব্যানারে একটি মিছিল বের হয় এবং সেখানে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মধ্যদিয়ে তা শেষ হয়। এই সমাবেশে তারা হাইকোর্টের রায়কে ‘মেধাবীদের সঙ্গে তামাশা’ বলে প্রত্যাখ্যান করে। সমাবেশে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র, বর্তমানে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) প্রধান নাহিদ ইসলাম পরদিন ৬ জুন বিকেল ৫টায় রাজু ভাস্কর্যে সমাবেশের ঘোষণা দেন।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ থেকে ছয়শ’ শিক্ষার্থী ওই মিছিলে অংশ নেয় এবং স্লোগান দেয়Ñ ‘কোটা পদ্ধতি মানি না’, ‘হাইকোর্টের রায় মানি না’, ‘কোটা বাতিল করতেই হবে’।

আসিফের বক্তব্যের সাথে একমত প্রকাশ করে নাহিদও ৫ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে তাদের প্রথম বৈঠকের কথা এবং কীভাবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে পেরেছিলেন তা স্মরণ করেন। নাহিদ পরে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা ঈদুল আজহার ছুটির আগে মাত্র তিন দিন আন্দোলনের সুযোগ পেয়েছিলাম।’
৬ জুন ঢাবি, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জগন্নাথসহ দেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা কোটা বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ করে।

৯ জুন শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল করে অ্যাটর্নি জেনারেল বরাবর একটি স্মারকলিপি জমা দেয়। এর প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করে। শুনানির দিন ধার্য হয় ৪ জুলাই। ১০ জুন আবারও মিছিল হয় এবং শিক্ষার্থীরা সরকারকে ৩০ জুনের মধ্যে ২০১৮ সালের প্রজ্ঞাপন পুনর্বহাল করতে আল্টিমেটাম দেয়, না হলে সর্বাত্মক আন্দোলন শুরু করার ঘোষণা দেয়।

উপদেষ্টা আসিফ স্মরণ করেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ৩০ জুন পর্যন্ত ঈদের ছুটি ঘোষণা করেছিল, তাই আমরা সেই দিনটিকে আল্টিমেটামের সময়সীমা হিসেবে নির্ধারণ করি। আমরা সরকারকে সতর্কও করেছিলাম যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আমাদের দাবি পূরণ না হয়, তাহলে আমরা আবার আন্দোলন শুরু করব।’
৩০ জুন সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ঘোষণা না আসায় ১ জুলাই ঢাবি, জগন্নাথ, জাবি, রাবি, চবি, বরিশাল ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমে পড়ে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কিছু সময়ের জন্য ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ এর ব্যানারে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার প্রাঙ্গণ থেকে একটি মিছিল বের করে; যা রাজু ভাস্কর্যে শেষ হয়। সমাবেশ থেকে নাহিদ ইসলাম ঘোষণা দেন, আগামী ৪ জুলাই পর্যন্ত দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ও পরীক্ষার বর্জন চলবে। তিনি তিন দিনের কর্মসূচিও ঘোষণা করেন ২ জুলাই দেশব্যাপী মহাসড়কে মিছিল; ৩ ও ৪ জুলাই রাজধানীর রাজু ভাস্কর্যে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত সরকারি কলেজ এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সমাবেশ। সমাবেশে নাহিদ ইসলাম ঘোষণা দেন ৪ জুলাই পর্যন্ত দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন চলবে। সেই সঙ্গে তিনি চারটি দাবি উত্থাপন করেন ১. দ্রুত কোটা সংস্কারে কমিশন গঠন, যেন পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী উপকৃত হয়। ২. কোটা পূরণ না হলে মেধাভিত্তিক নিয়োগ নিশ্চিত করা। ৩. নিয়োগে একাধিকবার কোটা সুবিধা ব্যবহার বন্ধ করা। ৪. প্রশাসনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।

কিন্তু শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেয়নি সরকার। শিক্ষার্থীরাও অনড় থাকে। এরই মধ্যে শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আপত্তিকর মন্তব্য করেন। সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিকের প্রশ্নে তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা (কোটা সুবিধা) পাবে না, তাহলে কী রাজাকারের নাতি-পুতিরা পাবে? তার এই বক্তব্যে চরম ক্ষুব্ধ হন শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসেন। তারা বিক্ষোভ করেন। তাদের স্লোগান ছিল ‘তুমি কে আমি কে/ রাজাকার রাজাকার। কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার, স্বৈরাচার। চাইতে গেলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজার। 

আওয়ামী লীগ এবং তাদের জোটের কয়েকটি দল ছাড়া দেশের সব রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন শিক্ষার্থীদের প্রতি সংহতি জানান। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তারাও রাস্তায় নেমে আসেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সঙ্গে তাদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। প্রতিদিনই লাশ পড়তে থাকে। দিনদিন এই সংখ্যা বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেয়। কিন্তু সমাজ থেকে কী বৈষম্য গেছে? না। ঘুষ, দুর্নীতি, হত্যা, ধর্ষণ, চুরি, ছিনতাই হচ্ছে অহরহ। এই সরকারের আমলে  নতুন করে ২৭ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিপিডির দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্তের ত্রাহী অবস্থা। ধনী-গরীবের বৈষম্য বাড়ছে। ধনী আরও ধনবান হচ্ছেন আর গরিব আরও গরিব হচ্ছেন। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায় জুলাই অভ্যুত্থান ব্যর্থতায় রূপ নেবে। 

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক

আরটিভি/এফএ

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিজ্ঞাপন

Loading...


© All Rights Reserved 2016-2025 | RTV Online | It is illegal to use contents, pictures, and videos of this website without authority's permission