বাংলা সাহিত্যের কথার জাদুকর তিনি। গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণ, আত্মজৈবনিক, কিশোর সাহিত্য, গান-কবিতাসহ নানান স্বাদের লেখায় পাঠকের মন জয় করে নিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি নির্মাণ করেছেন কালজয়ী অসংখ্যা নাটক ও সিনেমা। তিনি আর কেউ নন দেশের কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। গুণি এ মানুষটির ১৩তম মৃত্যুবার্ষিকী শনিবার (১৯ জুলাই)। ২০১২ সালের আজকের এই দিনে যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তাকে হারানোর বেদনায় বাংলাভাষী পাঠকদের মন এখনও শোকাচ্ছন্ন।
হুমায়ূন আহমেদের জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোণার কেন্দুয়া উপজেলার কুতুবপুরে। ডাকনাম কাজল। বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ও মা আয়েশা ফয়েজের প্রথম সন্তান তিনি। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। কথাসাহিত্যিক জাফর ইকবাল তার ছোট ভাই। সবার ছোট ভাই আহসান হাবীব নামকরা কার্টুনিস্ট ও রম্যলেখক।
ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখির প্রতি হুমায়ূন আহমেদের ছিলো দারুণ অনুরাগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থাতে মুহসীন হলের থাকাকালীন সময়ে লিখেন প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’। এই উপন্যাসের মাধ্যমেই জানান দিয়েছিলেন- নতুন তারার আবির্ভাব হতে চললো। ‘শঙ্খনীল কারাগার’ তার দ্বিতীয় উপন্যাস। দুটি উপন্যাস পাঠকপ্রিয় হতে সময় নেয়নি। এরপর যেখানেই হাত দিয়েছেন হুমায়ূন সেখানেই সোনা ফলেছে যেন।
সময়ের পালাবদলে কয়েক দশকের সাহিত্যজীবনে তিনি রচনা করেছেন প্রায় তিনশর মতো বিভিন্ন স্বাদের গ্রন্থ। যা বিশ্বসাহিত্যেও লেখক হিসেবে তাকে দিয়েছে অনন্য মর্যাদা। তার আলোচিত গ্রন্থাবলির মধ্যে রয়েছে, এইসব দিনরাত্রি, জোছনা ও জননীর গল্প, মন্দ্রসপ্তক, দূরে কোথাও, সৌরভ, কৃষ্ণপক্ষ, সাজঘর, বাসর, গৌরীপুর জংশন, বহুব্রীহি, আশাবরী, দারুচিনি দ্বীপ, শুভ্র, নক্ষত্রের রাত, আমার আছে জল, কোথাও কেউ নেই, আগুনের পরশমণি, শ্রাবণ মেঘের দিন, মেঘ বলেছে যাবো যাবো, মাতাল হাওয়া, শুভ্র গেছে বনে, বাদশাহ নামদার, এপিটাফ, রূপা, আমরা কেউ বাসায় নেই, মেঘের ওপারে বাড়ি, আজ চিত্রার বিয়ে, এই মেঘ, রৌদ্রছায়া, তিথির নীল তোয়ালে, জলপদ্ম, আয়নাঘর, হুমায়ূন আহমেদের হাতে পাঁচটি নীলপদ্ম অন্যতম।
বাংলা সাহিত্যে নতুন যুগের স্রষ্টা ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। সাহিত্যকে সর্বজনীন পাঠকের কাছে জনপ্রিয় করে তুলতে কিংবদন্তি এ কথাশিল্পীর অবদান ইতিহাসে লেখা থাকবে। হিমু, মিসির আলী, রূপা, শুভ্র’র মতো তার নির্মিত চরিত্রগুলো সাহিত্যের কালের যাত্রায় স্থান নিয়েছে। শুধু সাহিত্যেই নয়, নাটক ও সিনেমায় তার নির্মিত কিছু চরিত্রও ছিলো আশ্চর্য রকম জীবন্ত। হুমায়ূন আহমেদের তৈরি করা বিচিত্র সব চরিত্র অগুনতি মানুষকে হাসিয়েছে, কাঁদিয়েছে, স্বপ্নে ভাসিয়েছে। একেকটি চরিত্র পাঠক-দর্শকদের কাছে একেকটি নতুন আবিষ্কার। সাহিত্যের চরিত্রগুলোই বিভিন্ন সময় উঠে এসেছে তার নাটক-সিনেমায়। হুমায়ূনের গড়া এসব চরিত্রে কখনও কখনও তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন নিজের প্রতিরূপ।
কবিতা দিয়ে লেখালেখি শুরু করে নাটক, শিশুসাহিত্য, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, চলচ্চিত্র পরিচালনা থেকে শিল্প-সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি রেখে গেছেন নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর।
দীর্ঘদিন কোলন ক্যানসারে ভুগছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। দীর্ঘ ৯ মাস চিকিৎসাধীন থাকার পর ২০১২ সালের ১৯ জুলাই স্থানীয় সময় ১১টা ২০ মিনিটে নিউইয়র্কের বেলভিউ হসপিটালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাংলা সাহিত্যের এই প্রবাদপুরুষ। এর আগে ১২ দফায় কেমোথেরাপি দেওয়া হয়েছিল তাকে। অস্ত্রোপচারের পর শারীরিক অবস্থা কিছুটা উন্নতি হলেও শেষ মুহূর্তে শরীরে অজ্ঞাত ভাইরাস আক্রমণ করায় দ্রুত অবনতি ঘটে। কৃত্রিমভাবে লাইফ সাপোর্টে রাখার পর আজকের দিনে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান হুমায়ূন আহমেদ।
হুমায়ূন আহমেদের প্রতি দেশের মানুষের ভালোবাসা ছিলো আকাশসম। যার প্রমাণ পাওয়া যায় তার মৃত্যুতে। বাংলা সাহিত্যে আর কোনো লেখকের মৃত্যু এভাবে শোকাহত করেনি বাংলা সাহিত্যের পাঠককে। কোনো লেখকের জন্য এত শোক মিছিল দেখেনি জাতি। শেষ শ্রদ্ধা জানাতে তার মরদেহ শহীদ মিনারে নিয়ে যাওয়ার পর সর্বস্তরের মানুষের যে ঢল নেমেছিল তা ইতিহাস হয়েই থাকবে।
বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৯৪ সালে একুশে পদক লাভ করেন। এ ছাড়া বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮১), হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০), লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৩ ও ১৯৯৪) ও বাচসাস পুরস্কার (১৯৮৮) লাভ করেন।
পারিবারিক জীবনে তিনি দুটি বিয়ে করেন। প্রথম স্ত্রীর নাম গুলতেকিন আহমেদ। এ দম্পতির তিন মেয়ে ও দুই ছেলে। তারা হলেন বিপাশা আহমেদ, নোভা আহমেদ, শীলা আহমেদ ও নাম নুহাশ আহমেদ। ২০০৫ সালে গুলতেকিনের সঙ্গে তার বিচ্ছেদ হয় এবং ওই বছরই অভিনেত্রী শাওনকে বিয়ে করেন তিনি। এ ঘরে তার দুটি সন্তান, নিষাদ হুমায়ূন ও নিনিত হুমায়ূন।
আরটিভি/এএ/এস