রাজশাহী বাগমারা উপজেলার তাহেরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (চলতি) দায়িত্ব থাকা সৈয়দ জুবায়ের মোহাম্মদ কিবরিয়া। ২০০০ সালে সহকারী শিক্ষক হিসেবে তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন। এরমধ্যেই শিক্ষকতা জীবনের কেটে গেছে প্রায় ২৫টি বছর। কিন্তু এই ২৫ বছরের তার শিক্ষকতার আমলনামায় উঠে এসেছে, রাজনৈতিক প্রভাব,অনিয়ম, জালিয়াতি, গাইড বাণিজ্য, বেপরোয়া আচরণসহ নানান অভিযোগ। এত এত অভিযোগের পরও তার বিরুদ্ধেও দৃশ্যমান কোন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি খোদ উপজেলা ও জেলা সরকারি প্রাথমিক শিক্ষা অফিসকে। এই শিক্ষককের এসব অভিযোগ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মত টানা ৩ সপ্তাহ ধরে অনুসন্ধান চালায় আরটিভি নিউজ। ওঠে আসে একের পর এক ভয়ংকর তথ্য। অভিযুক্ত সেই প্রধান শিক্ষক এবার নিউজ ঠেকাতে ছুটে আসেন রাজশাহী আরটিভি অফিসে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকার পর অর্থ দিয়ে ম্যানেজ করার চেষ্টা চালানো হয় এই প্রতিবেদকে। পরে ব্যর্থ হয়ে অনুরোধ জানান নিউজ প্রকাশ না করতে। অভিযুক্ত এই শিক্ষকের অডিওসহ নানান তথ্য প্রমাণ আরটিভি নিউজের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে।
স্কুলেই জমে আড্ডাখানা:
তাহেরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টিতে প্রবেশ করলেই বেশ কয়েকটি রুমের পর চোখে পড়বে। ছোট একটি রুম। যে রুমটি দেওয়ালের ওপরে একটি ছোট্ট সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে সৈয়দ জুবায়ের মো. কিবরিয়া,প্রধান শিক্ষক,তাহেরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। অথচ অভিযুক্ত এই শিক্ষক ২০২৪ সালে যোগদানের আগেও এই রুমটি সহকারী শিক্ষকেরা, অবসর সময়ে, খাওয়া দাওয়া, বিশ্রামাগার, এবং অনেক অভিভাবক ব্রেস্ট ফিডিং করতেন। কিন্তু এসব কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে রুমটিতে নিজের আড্ডাখানা গড়ে তেলেন সৈয়দ জুবায়ের মো: কিবরিয়া, যেখানে আড্ডা দেন, রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক, গাইড কোম্পানির লোকেরা। এনিয়ে শিক্ষকেরা প্রতিবাদ করতে গেলেও স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতাদের দিয়ে নানন ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ রয়েছে এই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে।
অতীতে রয়েছে স্কুল ফাঁকির রেকর্ড:
তাহেরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষকের চলতি দায়িত্বে থাকা কিবরিয়া, তিনি প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম ছাড়া তার নিয়ম বাস্তবায়নে তিনি বদ্ধপরিকর। স্কুলে খেয়াল খুশি মত আসেন আবার চলে যান। তবে অন্য শিক্ষকেরা দেরি করলে সবার সামনে তাদের করা হয় অপমান। এই কিবরিয়ার বিরুদ্ধে স্কুল ফাঁকি দেয়ার অভিযোগ রয়েছে, যেমন ২০১৭ সালে, দরগামাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে থাকাকালে তার নেতৃত্বে ১৫ জন শিক্ষককে নিয়ে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে শিক্ষক সমিতির নির্বাচনের নামে আগাম প্রচারণা ২০ দিন ধরে চালানোর অভিযোগ উঠে এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে। তৎকালীন বাগমারা উপজেলার ভারপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এ বি এম ছানোয়ার হোসেন ওই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগ স্বীকারও করেন। এনিয়ে স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিকে ফলাও করে বিভিন্ন পাত্র-পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়। কিন্তু ওই এলাকার আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি এবং মেয়রের সাথে সু-সম্পর্ক থাকার কারণে শিক্ষা কর্মকর্তারা মৌখিকভাবে সতর্ক করে কোন রকম দায় সারেন।
স্কুলের ফ্যান খুলে বিক্রি:
তাহেরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের অভিযোগ চলতি দায়িত্বে থাকা প্রধান শিক্ষক কিবরিয়া ২০২৪ সালের ৯ মে যোগদানের এক দেড়মাস পর কয়েকটি শ্রেণিকক্ষ থেকে ব্যবহারযোগ্য বেশ কিছু ফ্যান কাউকে কোন কিছু না জানিয়ে নিজে খুলে বিক্রি করে দেয়। এনিয়ে শিক্ষকরা প্রতিবাদ করলে তিনি জানান ফ্যানগুলো নষ্ট ছিলো, সেই ফ্যানগুলে বিক্রি করে নিজের পকেটে টাকা ভরেন এই শিক্ষক। পরে নতুন ফ্যান কেনার ভাউচার জমা দেন।
স্বাক্ষর জালিয়াতির মাধ্যমে শিক্ষক যোগদান:
সৈয়দ জুবায়ের মো. কিবরিয়া সহকারী শিক্ষক হিসেবে চাকরি করেছেন দরগামারিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। চাকরিকালে সেখানেও তিনি প্রধান শিক্ষকের স্বাক্ষর জালিয়াতি করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
জানা যায়, দরগামারিয়া প্রধান শিক্ষক জাহানারা বেগম বেশ কিছুদিন ছুটিতে ছিলেন এসময় এক শিক্ষককে তার স্বাক্ষর জালিয়াতি করে কিবরিয়া যোগদান করানোর অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে ওই স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক জাহানারা বেগম বলেন, আমার স্বামী মারা গিয়েছে, আমার তেমন কেউ নাই, আমি এগুলো নিয়ে নতুন করে ঝামেলায় জড়াতে চাই না, তবে অভিযুক্ত শিক্ষক কিবরিয়া ঝমেলার অভাব নেই। তার অনেকগুলো সমস্যা রয়েছে। এর থেকে আর কোন কিছু বলতে চাচ্ছি না।
এ বিষয়ে জুবায়ের মো. কিবরিয়া বলেন, আমি কোন ধরনের স্বাক্ষর জালিয়াতি করিনি, ওই সময় ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা ছুটিতে থাকার কারণে তৎকালীন শিক্ষা অফিসার হান্নান স্যারের পরামর্শেই তার নির্দেশনা অনুযায়ী সীল স্বাক্ষর দিয়ে যোগদান করানো হয় এক শিক্ষককে।
শিক্ষা অফিসে হেড ক্লার্ক পেটানোর অভিযোগ:
ভবানীগঞ্জ শিক্ষা অফিসের অফিসের হেড ক্লাক ইউসুফ। বর্তমানে তিনি অবসরে গিয়েছেন। একদিন শিক্ষক কিবরিয়া সেই অফিসে কাজে গিয়েছিলেন তার কাজ গুরুত্ব না দেওয়ায় তাকে লাঞ্চিত করার অভিযোগ ওঠে।
এ বিষয়ে সাজুরিয়া মির্জাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক শহারিয়ার সরকার বাবলু জানান, কিবরিয়া শিক্ষকতা করার কোন যোগ্যতা নেই, আমি অনেক কিছুই জানি তার বিষয়ে, সে শিক্ষকদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার থেকে শুরু করে নানান অপকর্ম সঙ্গে জড়িত। তবে এ বিষয়ে অভিযুক্ত শিক্ষক কিবরিয়া বলেন, ইউসুফের সঙ্গে এমন কোন ঘটনায় ঘটেনি, বরং ইউসুফ ঘুষ বাণিজ্য সহ চাকরিকরাকালীন সময়ে বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডে সঙ্গে জড়িত ছিল।
ভবানীগঞ্জের বান্ধাইগাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শফিকুর রহমান আজাদ বলেন, শিক্ষক কিবরিয়ার, ব্যাপক সমস্যা রয়েছে, সে চাকরিকরা কালীন সময়ে সে আমার কথা শুনতো না, অন্যান্য শিক্ষকদের সঙ্গেও বাকবিতণ্ডায় জড়াত, এমনকি এলাকাবাসীর সঙ্গেও তার বেশ কয়েকবার কথা কাটাকাটি হয়। তার আচরণগত সমস্যা রয়েছে, পরবর্তীতে তাকে অফিসিয়াল নিয়মে বদলি করা হয়।
এ বিষয়ে রাজশাহী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার এ কে এম আনোয়ার হোসেন বলেন, আমার কাছে এমন তথ্য আসলে আর সত্যতা পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এর আগে ২২ জুন সাবেক এমপি কালামের আশীর্বাদে এক লাফে প্রধান শিক্ষক তিনি! এই শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ হলে বেশ তোলপাড় সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে ২৫ জুন অভিযোগের বিষয়ে সরোজমিনে তাহেরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অনুসন্ধানে যান শিক্ষা কর্মকর্তারা।
আরটিভি/এএএ