উদ্বোধনের আগেই ধ্বংস হয়ে গেল কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের পাশে ৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত নান্দনিক সৈকত সড়ক (মেরিন ড্রাইভ)। সমুদ্রের তীব্র ভাঙনে ইতোমধ্যে রাস্তাটির অধিকাংশ ধসে পড়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগ নিম্নমানের কাজ আর পরিকল্পনাহীনভাবে নির্মাণ করায় এত বড় প্রকল্প অল্প সময়ের মধ্যে সমুদ্রে ভেসে গেল।
স্থানীয় বাসিন্দা গাজী হানিফ বলেন, গাইড ওয়াল ছাড়া এমন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় রাস্তা নির্মাণ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। পরিকল্পনা ছাড়া সরকারের কোটি টাকার প্রকল্প এভাবে ধ্বংস হয়ে যাওয়া উদ্বেগজনক।
জানা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে সাগরকন্যাকে নতুন করে সাজানোর জন্য এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়। কুয়াকাটা পৌরসভার আওতায় ১৩শ মিটার দীর্ঘ এই সড়ক নির্মাণের প্রকল্প নেয়া হয় আই ইউ আই ডি পি ফেস-২ এর অধীনে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স মোল্লা ট্রেডার্স, মেসার্স আবরার ট্রেডার্স ও এস এম ট্রেডার্স কাজ পায়।
ঠিকাদার সাদ্দাম মাল, বেল্লাল হোসেন, ছগির মোল্লা ছিলেন সাবেক মেয়রের ঘনিষ্ঠজন। ইতিমধ্যে প্রকল্পের বিপরীতে ১ কোটি ৭৬ লাখ টাকার বিল উত্তোলন করা হয়েছে। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ম-নীতি তোয়াক্কা না করে নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী দ্বারা কাজ করে। নির্মাণ কাজ শেষ না হতেই গত ২৯ মে ঘূর্ণিঝড় শক্তির প্রভাবে সৈকত সড়কের বিভিন্ন জায়গায় ধসে পড়ে।
এরপর নির্মাণ কাজের অনিয়ম খতিয়ে দেখার জন্য কুয়াকাটা পৌর প্রশাসক ও কলাপাড়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ইয়াসীন সাদেককে প্রধান করে ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন উপজেলা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী, উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী, উপজেলা এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী ও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা। সাত কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা থাকলেও দু'মাসে তা আলোর মুখ দেখেনি। সমুদ্র শাসন না করে নির্মাণ কাজ করায় প্রকল্পটি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হল।
কুয়াকাটা প্রেসক্লাবের সভাপতি রুমান ইমতিয়াজ তুষার বলেন, প্রতিবছর জিওব্যাগ দিয়ে একটি নাম মাত্র প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। যা সৈকত রক্ষায় কোনো কাজে আসছে না। কুয়াকাটায় রক্ষায় দরকার স্থায়ী বাঁধ। সমুদ্র শাসন না করে সৈকত সড়কটি নির্মাণের উদ্যোগ এক ধরনের বিলাসী প্রকল্প।
গত কয়েকদিনের আমাবস্যার জোয়ার ও নিম্নচাপের প্রভাবে সাগরের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে সমুদ্রের ঢেউয়ে ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে। এই ভাঙনে মেরিন ড্রাইভ ও পাশের সবুজ বেষ্টনীর প্রকল্প মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এলাকাবাসীর আশঙ্কা, পুরো এলাকাটিই যদি দ্রুত পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে আরও বড় ক্ষতির মুখে পড়বে। স্থানীয় সচেতন মহলের দাবি, এমন গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় টেকসই পরিকল্পনা এবং বিশেষজ্ঞ পরামর্শ ছাড়া কাজ করে জনগণের অর্থ অপচয় করা হয়েছে।
সৌন্দর্য বর্ধন ও পর্যটকদের চলাচলের সুবিধার্থে কুয়াকাটা পৌরসভার উদ্যোগে হোটেল সিভিউ থেকে ঝাউবন পর্যন্ত ১হাজার ৩০০ মিটার সৈকত সড়ক নির্মাণ প্রকল্প এখন চরম সমালোচনার মুখে। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয় ৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। তবে নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার আগেই জোয়ারের পানিতে গত ২৯ মে ঘূর্ণিঝড় শক্তির প্রভাবে সড়কটির কিছু অংশ সমুদ্রে ধসে পড়ে। নিম্নমানের কাজের জন্য স্থানীয়দের মাঝে ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে।
এ ঘটনার পরপরই ২৯ মে কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইউএনও রবিউল ইসলাম ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ইয়াসিন সাদেককে প্রধান করে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন, উপজেলা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী কর্মকর্তা, এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী ও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা। কমিটিকে ৭ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার কথা উল্লেখ থাকলেও গত দু'পাশে তদন্ত আলোর মুখ দেখেনি।
গত কয়েকদিনের লঘুচাপের প্রভাবে সাগরের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে সমুদ্রের ঢেউয়ে ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে। এই ভাঙনে মেরিন ড্রাইভ ও পাশের সবুজ বেষ্টনীর প্রকল্প মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গতকাল নিম্নচাপ ও আমাবস্যার জোয়ের প্রভাবে সড়কটির পুরোপুরি অংশ সমুদ্রে বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়াও সৈকত লাগোয়া বিভিন্ন স্থাপনা ট্যুরিষ্ট পুলিশ বক্স, ডিসিপার্ক রয়েছে ঝুঁকি মধ্যে। এলাকাবাসীর আশঙ্কা, পুরো এলাকাটিই যদি দ্রুত পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে আরও বড় ক্ষতির মুখে পড়বে।
স্থানীয় বাসিন্দা সোহেল বলেন, পরিকল্পনা ছাড়া সমুদ্র রক্ষার নামে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা নিছক বোকামী। নিজস্ব লোকজন দিয়ে প্রকল্পটাকে যারা চেটেপুটে খেয়েছেন তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনার জোর দাবি জানাই।
সৈকত সড়কটি রক্ষার দাবিতে শনিবার (২৬ জুলাই) সকালে ডিসি পার্ক সংলগ্ন বিধ্বস্ত সড়কটিতে মানববন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। এতে কুয়াকাটার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, সাংবাদিক, সুশীল সমাজ, শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষ অংশগ্রহণ করেন।
এসময় বক্তারা বলেন, অব্যাহতভাবে ভাঙ্গনের ফলে সৈকতের সৌন্দর্য ও পরিবেশ ধ্বংস হওয়ায় পর্যটকদের আগ্রহ কমে যাচ্ছে যা কুয়াকাটার পর্যটন অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকি।
তারা দ্রুত সৈকতের সৌন্দর্য রক্ষা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নতকরণ, অবৈধ দখলমুক্তকরণ এবং ট্যুরিস্ট ফ্যাসিলিটিজ বৃদ্ধির দাবিতে সরকারের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, ইট ও বালু দিয়ে নিম্নমানের কাজ করেছে প্রতিষ্ঠানগুলো। অথচ পৌর মেয়রের ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় কেউ মুখ খুলতে সাহস পাননি। ইতিমধ্যে প্রকল্পের বিপরীতে ১ কোটি ৭৬ লাখ টাকার বিল উত্তোলন করা হয়েছে।
স্থানীয় প্রশাসন, নাগরিক সমাজ ও পর্যটকদের চোখে এখন এ প্রকল্পটি ‘দৃষ্টান্তমূলক ব্যর্থতা’র প্রতীক। কোটি টাকার প্রকল্পে দায়িত্বহীনতা, স্বজনপ্রীতি ও পরিকল্পনার অভাব—সব মিলিয়ে প্রকৃত তদন্ত ও দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থার দাবি জানাচ্ছেন সকলে।
স্থানীয় বাসিন্দা আল আমিন বলেন, ৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকার প্রকল্প থেকে ১ কোটি ৭৬ লাখ টাকা উত্তোলন করা হলেও বাকি তিন কোটি টাকা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে না দিয়ে পুনরায় প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবি করছি।
পর্যটন ব্যবসায়ী জনী আলমগীর বলেন, কুয়াকাটা একটি আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন নগরী এটিকে এখনই রক্ষা করা জরুরি। সমুদ্র শাসন না করে এ ধরনের বিলাসী প্রকল্প নেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
এ বিষয়ে কুয়াকাটা পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান হাওলাদার বলেন, প্রতি বছর জিও ব্যাগের নামে অর্থ লোপাটের মহোৎসব বন্ধ করে গ্রোয়েন বাঁধের স্থায়ী প্রকল্প গ্রহণ করলে কুয়াকাটা সৈকত রক্ষা পাবে। পরিকল্পনা ছাড়া প্রকল্প গ্রহণ করলে এভাবেই সরকারের কোটি কোটি টাকা ভেস্তে যাবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক মেয়র আনোয়ার হাওলাদার স্বজনপ্রীতির অভিযোগ অস্বীকার করে গণমাধ্যমকে বলেন, টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই কাজ দেওয়া হয়েছে। এখানে কোন অনিয়মের সুযোগ নেই।
কুয়াকাটা পৌর প্রশাসক ইয়াসীন সাদেক বলেন, ৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকার প্রকল্প। ইতোমধ্যেই ১ কোটি ৭৬ লাখ টাকা বিল দেওয়া হয়েছে। বাকি ৩ কোটি টাকা দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অংশ মেরামত করিয়ে নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, ডিসি পার্ক থেকে জিরো পয়েন্ট এলাকা পর্যন্ত ১ কিলোমিটার জায়গা রক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ড ও কুয়াকাটা পৌরসভার যৌথ উদ্যোগে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
আরটিভি/এএএ -টি