শুক্রবার, ২৫ জুলাই ২০২৫ , ০১:০৪ পিএম
শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বজুড়েই বেদনার জাল বুনেছে মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি। বিমান দুর্ঘটনায় হতাহতের দৃশ্য দেখে চোখের জল পড়েনি, এমন মানুষ মাওয়া দুষ্কর। মনের অজান্তেই আমার চোখের জলও গড়িয়ে পড়েছে। ক্ষণে ক্ষণে কলিজার ভেতর মোচড় দিয়ে উঠেছে। নিহত কয়েকটি শিশুর লাশ যখন বের করে আনা হলো; তখন নিশ্বাস নিতে পারছিলাম না। এতটুকু শরীরে পাহাড় সমান কষ্ট! আহ্।
একজন শিক্ষক হিসেবে মাইলস্টোনকে আমার স্কুলই ভাবছিলাম। ওই শিশুদের আমার ছাত্রছাত্রী মনে হচ্ছিল। তারা যখন যন্ত্রণায় ছটফট করছিল; তখন তো শিক্ষক হিসেবে আমার হৃদয়ে পানি থাকার কথা নয়। আদতে হয়েছিলও তা-ই। আমার হৃদয়ে পানি ছিল না। একবার বসছিলাম, আবার দাঁড়াচ্ছিলাম। কখনো পায়চারি করছিলাম; কখনো বিছানায় শরীর এলিয়ে দিচ্ছিলাম। নারকীয় দৃশ্য দেখে কিছুই ভালো লাগছিল না। কেবলই অস্বস্তি। টেলিভিশন আর অনলাইন নিউজ পোর্টালে বার বার চোখ রাখছিলাম। মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে উৎকণ্ঠাও বাড়ছিল।
বিমান বাহিনীর এই জঙ্গি বিমান বিধ্বস্তে সারাদেশের মানুষ যখন শোকে মুহ্যমান; তখন অনেকেই নানা ধরনের প্রশ্ন তুলছেন। কেউ প্রশ্ন তুলছেন বিমানটির মডেল ও প্রযুক্তি নিয়ে; কেউ প্রশ্ন তুলছেন প্রশিক্ষণের এলাকা নিয়ে; পাইলটের দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন অনেকে। উদ্ধার কাজ; উপদেষ্টা ও রাজনীতিকদের চেহারা প্রদর্শন; অসচেতন জনগণ, সংবাদকর্মী ও কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের আচরণ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
তবে মনে হবে রাখতে হবে দুর্ঘটনা দুর্ঘটনা-ই। প্রতিদিনই তো দুর্ঘটনা ঘটছে। মানুষ মরছে। এগুলোর কয়টা আমরা মনে রাখছি? বুধবার যখন এই নিবন্ধ লিখছিলাম; তখন নাটোরে মাইক্রোবাস ও ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে ৮ জনের প্রাণহানির খবর নিউজ পোর্টালগুলোতে ভেসে বেড়াচ্ছিল। সব মৃত্যুই বেদনার। তবে কিছু মৃত্যু বিশেষ করে দুর্ঘটনায় শিশুদের মৃত্যুর বিষয়টি স্পর্শকাতর। এতে মানুষের আবেগ বেশি কাজ করে। এ কারণে এসব দুর্ঘটনা বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করে।
গত সোমবার রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনে বিমান বাহিনীর জঙ্গি প্রশিক্ষণ বিমান আছড়ে পড়ে। এতে সেখানে আগুন ধরে যায়। বুধবার পর্যন্ত পাইলটসহ নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৩২ হয়েছে।
উদ্ধার তৎপরতা: দুর্ঘটনার পরপরই সেখানে ফায়ার সার্ভিস উদ্ধার অভিযান শুরু করে। বিমান বাহিনীও উদ্ধার তৎপরতা চালায়। কিন্তু এই কার্যক্রম নিয়ে অনেকে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু সেখানে উদ্ধার অভিযান নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে না। বিশ্বব্যাপী উদ্ধার তৎপরতার ক্ষেত্রে অনুসৃত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাঠামো ইনসিডেন্ট কমান্ড সিস্টেম। সংক্ষেপে এটাকে আইসিএস বলা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ইমারজেন্সি ম্যানেজমেন্ট এজেন্সি (ফিমা); জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল সার্চ অ্যান্ড রিসোর্স অ্যাডভাইসরি গ্রুপ (ইনসারাগ); রেড ক্রস এবং ও ইউরোপীয় সিভিল প্রোটেকশন মেকানিজম আইসিএস মেনে চলে।
এই পদ্ধতি অনুযায়ী, দুর্ঘটনাস্থলকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। অপারেশনাল এরিয়া থাকে শুধুমাত্র প্রশিক্ষিত উদ্ধার কর্মীদের ওয়ার্ম জোন– লজিস্টিক ও সহায়তাকারী ইউনিটের। কোল্ড জোন– মিডিয়া, প্রশাসন, স্বজনদের নিয়ন্ত্রিত প্রবেশের জায়গা। সরাসরি উদ্ধারে জড়িত নন এমন কেউ হট বা ওয়ার্ম জোনে প্রবেশ করলে তা উদ্ধারকাজকে বিলম্বিত বা বিপজ্জনক করে তুলতে পারে।
বিশেষ করে, রাজনৈতিক নেতাদের আগমন মানেই নিরাপত্তা, মিডিয়া, ভিড় ও প্রশাসনিক চাপ; যা বিপর্যয় ব্যবস্থাপনার গতি কমিয়ে দেয়।
জাতিসংঘ ও রেড ক্রস বলছে, দুর্যোগপূর্ণ অঞ্চলে যে কোনো সরকারি পরিদর্শন অবশ্যই সমন্বিত ও সময়োপযোগী হতে হবে; যাতে জীবনরক্ষাকারী কার্যক্রম ব্যাহত না হয়। কিন্তু বাংলাদেশের পরিস্থিতি ভিন্ন। দুর্ঘটনা ঘটলেই ভিড় লেগে যায়। উৎসুক জনতার পাশাপাশি রাজনীতিকরা ভিড় জমান। আবার তাদের সঙ্গে থাকে ক্যামেরা, মাইক্রোফোন, অনুসারী। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, শোক প্রকাশ আর দুর্ঘটনার খবর লাইভ করলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির উপকার কী? এটি আন্তর্জাতিকনীতি ‘ডু নো হার্ম’ পরিপন্থী।
এই নীতি হলো, আপনি হয় উপকার করবেন, না হলে দূরে থাকবেন। ভিড় বাড়িয়ে, মিডিয়ার মনোযোগ ঘুরিয়ে এবং উদ্ধারকারীদের গতিবিধি সীমাবদ্ধ করে কেউ যদি নিজের রাজনৈতিক অবস্থান দৃশ্যমান করতে চান, সেটি অমানবিকতাও বটে।
অন্যদিকে, রাজধানী ঢাকা বিশ্বের অন্যতম জনবহুল দেশ। তেজগাঁও পুরনো বিমানবন্দর এবং কুর্মিটোলা এয়ারবেস এখানেই অবস্থিত। এখানে নিয়মিত যুদ্ধবিমান উড্ডয়ন কতটা নিরাপদ, এই প্রশ্ন উঠাই স্বাভাবিক।
আন্তর্জাতিক সিভিল অ্যাভিয়েশন অথরিটির অ্যানেক্স ২ ও ১১ অনুযায়ী, যে কোনো প্রশিক্ষণ ফ্লাইট পরিচালনার ক্ষেত্রে জনবসতিপূর্ণ এলাকার ওপর দিয়ে কম উচ্চতায় উড়ালকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। একইসঙ্গে, ন্যূনতম নিরাপদ অল্টিচিউড বজায় রাখা বাধ্যতামূলক, বিশেষ করে ঘনবসতি ও কূটনৈতিক এলাকাগুলোর ক্ষেত্রে।
উন্নত দেশগুলোতে কোথায় প্রশিক্ষণ হয়? জাপানে শহরের ওপর প্রশিক্ষণ নিষিদ্ধ। বেশিরভাগ প্রশিক্ষণ হয় সমুদ্রের ওপর বা নির্জন এলাকায়। যুক্তরাষ্ট্র জনবসতির ওপর কম উচ্চতায় প্রশিক্ষণ ফ্লাইট নিষিদ্ধ। প্যারিসের আকাশে প্রশিক্ষণ বিমান উড়ে না। নয়াদিল্লিতে কম উচ্চতায় সামরিক বিমান নিষিদ্ধ। প্রশিক্ষণ হয় উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, মহারাষ্ট্রের বিশাল ঘরানার সামরিক ঘাঁটিতে।
যুদ্ধবিমান অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ছুটে চলে। যান্ত্রিক ত্রুটি বা বৈমানিকের ভুলে জনবসতিতে বিমান বিধ্বস্ত হলে ব্যাপক প্রাণহানি ও ধ্বংস হতে পারে। যুদ্ধবিমানের শব্দ ১২০-১৪০ ডেসিবেল; যা দীর্ঘমেয়াদে শ্রবণশক্তি হ্রাস, হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। শিশু, বয়স্ক ও অসুস্থদের ওপর এই শব্দ মারাত্মক প্রভাব ফেলে। হঠাৎ বিকট শব্দ, ঘন ঘন ওড়ার শব্দে মানুষ আতঙ্কিত হয়। বাংলাদেশের দীর্ঘ উপকূলীয় এলাকা হতে পারে এই ধরনের প্রশিক্ষণের উপযুক্ত স্থান। তবে এ বিষয়ে সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এফ-৭ বিজিআই কেমন বিমান: মাইলস্টোনে বিধ্বস্ত হওয়া বিমানটি এফ-৭ বিজিআই। এটি চীনে তৈরি। এটাকে চেংডু জে-৭ সিরিজের সবচেয়ে উন্নত সংস্করণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি সোভিয়েত আমলের মিগ-২১ এর ওপর ভিত্তি করে তৈরি। মডেলটি বহু দেশে বহু দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে। বাংলাদেশ ২০১১ সালে চীনের কাছ থেকে ১৬টি এফ-৭ বিজিআই কেনে। ২০১৩ সালে এগুলো বহরে যুক্ত হয়। তবে ওই বছরই চীন এই মডেলের বিমান উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। অধিকাংশ দেশ মিগ-২১ বা অনুরূপ মডেলগুলো বাতিল করেছে। ভারতও এ মডেল থেকে বের হয়ে এসেছে বুধবার। তারা অবশ্য অনেক আগেই ২০২৫ সালের মধ্যে এ মডেল থেকে পুরোপুরি সরে আসার ঘোষণা দেয়। বাংলাদেশের প্রায় ৩৬টি এফ-৭ যুদ্ধ বিমান রয়েছে। এগুলোর বড় অংশ পুরনো প্রযুক্তির। এ থেকে বাংলাদেশের সরে আসা উচিত কি না, তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। মনে রাখতে হবে স্বল্প বাজেটে আধুনিক বিমানের কথা বলে দেশের মানুষ ও পাইলটকে বিপদে ফেলা যাবে না।
লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক।