images

দেশজুড়ে

সাবেক এমপি কালামের আশীর্বাদে এক লাফে প্রধান শিক্ষক তিনি!  

রোববার, ২২ জুন ২০২৫ , ০৬:৫৯ পিএম

সৈয়দ জুবায়ের মো. কিবরিয়া প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন বাগমারা মিরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষকতার পাশাপাশি শিক্ষক নেতা হওয়ার ইচ্ছেও ছিলো তার প্রবল। সে স্বপ্ন নিয়ে রাজশাহী বাগমারা-৪ আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলেন তিনি।  

রাত-দিন বেশির ভাগ সময়ে সাবেক এমপি কালামের ব্যক্তিগত চেম্বারে সময় অতিবাহিত করতেন সৈয়দ জুবায়ের মো. কিবরিয়া। এভাবে এক সময় সাবেক এমপি কালামের ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন এ শিক্ষক। 

শিক্ষক কিবরিয়া সাবেক এমপি কালামের হাতকে শক্তিশালী করতে ও শিক্ষক নেতা হওয়ার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে সাবেক এমপির ডিও লেটার ও অফিস আদেশ নিয়ে বেশ তড়িঘড়ি করে বাগমারা কর্মস্থল মিরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের পদ ছেড়ে চলে যান নতুন দায়িত্ব নিতে তাহেরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। অথচ তিনি পূর্বের কর্মস্থলে অফিস আদেশ অনুযায়ী কোনো কিছু জানিয়ে আসেননি। 

অনুসন্ধানে জানা যায়, সৈয়দ জুবায়ের মো. কিবরিয়া ২০০০ সালে শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করেন। চাকরি জীবনে ঘন ঘন বদলিতে অনন্য রেকর্ড রয়েছে তার। শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, ক্ষমতার দাপট এবং গাইড বাণিজ্য করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। 

এসব অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে প্রায় দুসপ্তাহ ধরে অনুসন্ধান চালায় আরটিভি নিউজ। যার বেশ কিছু অডিও এবং ভিডিও মিলেছে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে। 

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, তাহেরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টিতে প্রবেশ করলেই বেশ কয়েকটি রুমের ওপর চোখে পড়বে। তার পাশেই প্রধান শিক্ষক সৈয়দ জুবায়ের মো. কিবরিয়ার রুম। ঢুকতেই তার নেম প্লেটে বড় করে লেখা রয়েছে। তার পদবি সিনিয়র শিক্ষক অথচ তিনি প্রধান শিক্ষকের চলতি দায়িত্ব পালন করছেন। সেখানে বসেই তার নিজস্ব আইন বাস্তবায়ন করেন। 

অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সেখানে বসিয়ে রেখে গাইড কেনাসহ নানান ধরনের হয়রানি করে থাকেন তিনি। এতে করে শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকরা প্রধান শিক্ষক কিবরিয়ার প্রতি অসন্তুষ্ট।

গাইড বাণিজ্য
 
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে এক সিনিয়র সহকারী শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করছিলেন। ওই সময় হঠাৎ তার ক্লাস চলাকালে জুপিটার গাইড কোম্পানির প্রতিনিধি প্রকাশ্যে শ্রেণিকক্ষে ঢুকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে গাইডের লিফলেট বিতরণ করতে থাকেন। এ বিষয়ে তাদেরকে প্রশ্ন করলে   প্রধান শিক্ষকের অনুমতি রয়েছে বলে তাকে জানানো হয়।

একপর্যায়ে লিফলেট বিতরণ শেষে গাইড কোম্পানির প্রতিনিধিরা প্রধান শিক্ষক কিবরিয়ার রুমে কমিশন নিয়ে বৈঠকে বসেন। ৩০ মিনিটের সেই বৈঠকে কিবরিয়ার মনমতো কমিশন পাকাপোক্ত না হওয়ায় ওই গাইড কোম্পানির প্রতিনিধিদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে স্কুলটি থেকে কোম্পানির লোকজনকে বের করে দেন তিনি।

যদিও কিছুদিন পরে নতুনভাবে লেকচার কোম্পানির গাইডের প্রতিনিধিদের নিয়ে আবারও বিভিন্ন শ্রেণিকক্ষে গাইডের লিফলেট বিতরণ করেন। পরবর্তীতে প্রধান শিক্ষক কিবরিয়া তার রুমে কমিশন নিয়ে বৈঠকে বসেন। সেখানে সন্তোষজনক কমিশন পাওয়ার আশ্বাস পেলে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করেন গাইড কিনতে।

আওয়ামী লীগ আমলে কিবরিয়া দাপট 

সাবেক এমপি কালামের ঘনিষ্টজন হওয়ায় প্রধান শিক্ষক কিবরিয়া তার একক আধিপত্য ও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে চালিয়ে যেতেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ফলে সহকারী শিক্ষকরাও সব সময় থাকতেন আতঙ্কে।

এ ছাড়াও বিভিন্ন বিদ্যালয়ে কিবরিয়া দায়িত্ব পালনকালে অর্থ আত্মসাৎ, অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও অসৌজন্যমূলক আচারণের কারণে বার বার তোপের মুখ পড়েন সহকারী শিক্ষকদের। 

এর আগে একটি স্কুল থেকে ভবানীগঞ্জের মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক কিবরিয়া যোগদান করতে গেলে তাকে বাধা প্রদান করেন  ওই স্কুলটির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়াও ভবানীগঞ্জের বান্ধাইগাড়া বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শফিকুর রহমান একই অভিযোগে তাকে যোগদানে বাধা প্রদান করেন।

আওয়ামী লীগ ছেড়ে এখন বিএনপিতে যোগদান

দেশে ৫ আগস্ট পটপরিবর্তন পরপরই হঠাৎ করে আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি কালামের ঘনিষ্ঠ হওয়া কিবরিয়া এখন সাবেক মেয়র ও তাহেরপুর পৌর বিএনপির সভাপতি আ ন ম সামসুর রহমান মিন্টুর ঘনিষ্ঠ হিসেবে নিজেকে প্রচার করতে থাকেন। এর ফলে তাহেরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোন সমস্যা হলে বিএনপি নেতা ও শিক্ষক ইকবালের মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করেন প্রধান শিক্ষক সৈয়দ জুবায়ের মো. কিবরিয়া। সেই পরিচয়ে তিনি পুরো স্কুল এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। ফলে তার ভয়ে কেউ মুখ খুলতে নারাজ।

শিক্ষকদের জিম্মি

প্রধান শিক্ষক কিবরিয়া এক সময় আওয়ামী লীগের দাপট দেখালে এখন বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের বিএনপি নেতা ইকবালের মাধ্যমে ভয়ভীতি দেখিয়ে আসছেন। শ্রেণিকক্ষে গাইড বাণিজ্যের বিরোধিতা করলে সহকারী শিক্ষকদের ভয়-ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ রয়েছে প্রধান শিক্ষক কিবরিয়ার বিরুদ্ধে। 

এ ছাড়াও সহকারী শিক্ষকদের অসুস্থতার কারণে জরুরি ছুটি প্রয়োজন হলেও কোনো ধরনের ছুটি দেওয়া হয়না বলে জানান একাধিক সহকারী শিক্ষক। 

শিক্ষকরা জানান, প্রধান শিক্ষক কিবরিয়ার অনিয়ম ও গাইড বাণিজ্যের বিষয়ে মুখ খুললে তিনি সহকারী শিক্ষকদের এসিআর অর্থাৎ বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনে বিরুদ্ধে লিখবেন বলে হুমকি দেন। 

জানা যায়, এসিআর যদি কোনো সহকারী শিক্ষকের বিপক্ষে যায় তাহলে তার পদোন্নতি বা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে তিনি বঞ্চিত হবেন। এই বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন কিবরিয়া। ফলে প্রকাশ্যে বা লিখিত আকারে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতে পারেন না সহকারী শিক্ষকরা। 

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সহকারী শিক্ষক জানান, প্রধান শিক্ষক কিবরিয়া তাহেরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নতুন করে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করেছেন। গাইড বাণিজ্য থেকে অনিয়ম করলেও তার বিষয়ে কোনো কথা বলা যায় না। 

গাইড বাণিজ্যের বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক অভিভাবক জানান, বিদ্যালয়টি থেকে যে গাইড বলে দেওয়া হয়ে থাকে, সেটি কিনে বাচ্চাদের দিতে হয়। সেই গাইড দিয়ে বিভিন্ন সময় স্কুলেও পড়ানো হয়।  

এ সবের অভিযোগ সত্যতা জানতে তাহেরপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গেলে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বলতে রাজি হননি অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক সৈয়দ জুবায়ের মো. কিবরিয়া।

এ বিষয়ে রাজশাহী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার এ কে এম আনোয়ার হোসেন বলেন, বিষয়টি আমার জানা ছিল না। এই অভিযোগগুলোর বিরুদ্ধে একজন কর্মকর্তাকে অনুসন্ধানে পাঠানো হবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

আরটিভি/এমকে